ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি: মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় অজানা রহস্য

ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি কি ?

 

মানব সভ্যতা বিজ্ঞানের মাধ্যমে মহাবিশ্ব সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছে, তবে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা। এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো: মহাবিশ্বের প্রকৃত উপাদান কী? আশ্চর্যজনকভাবে, বিজ্ঞানীরা জানেন যে আমরা যা দেখি, যেমন তারা, গ্যাস, গ্রহ, ধূলিকণা — সবকিছু মিলিয়েও মহাবিশ্বের মোট ভরের মাত্র ৫%। বাকি ৯৫% রয়েছে আমাদের চোখের আড়ালে — এটি হলো ডার্ক ম্যাটার (অন্ধকার পদার্থ) ও ডার্ক এনার্জি (অন্ধকার শক্তি)।

 

ডার্ক ম্যাটার: অদৃশ্য ভর

 

ডার্ক ম্যাটার হলো এমন এক ধরনের পদার্থ যা আলো বা অন্য কোনো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রশ্মি বিকিরণ করে না, এবং তাই এটি সরাসরি দেখা যায় না। তবে এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায় মহাবিশ্বের বস্তুর ওপর এর মহাকর্ষীয় টানের মাধ্যমে।

 

১৯৩০-এর দশকে সুইস জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিটজ জুয়িকি প্রথম এই ডার্ক ম্যাটারের ধারণা দেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, কিছু গ্যালাক্সির গতিবিধি ব্যাখ্যা করার জন্য দৃশ্যমান ভর যথেষ্ট নয়। অর্থাৎ, গ্যালাক্সিগুলো এত দ্রুত ঘুরছিল যে তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে না। তাই বোঝা গেল, সেখানে এমন কিছু আছে যা দেখা যাচ্ছে না কিন্তু তার মহাকর্ষীয় টান রয়েছে — এটিই ডার্ক ম্যাটার।

 

ডার্ক ম্যাটার কী দিয়ে গঠিত?

 

আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পারেননি ডার্ক ম্যাটার আসলে কী। তবে কিছু সম্ভাব্য কণার কথা বলা হয়, যেমন:

 

1. WIMPs (Weakly Interacting Massive Particles): এটি এমন এক ধরনের কণা যেগুলোর ভর রয়েছে কিন্তু এগুলো খুব দুর্বলভাবে অন্যান্য কণার সঙ্গে বিক্রিয়া করে।

2. Axions: হালকা ও অতিসূক্ষ্ম কণা, যেগুলো ডার্ক ম্যাটারের সম্ভাব্য প্রার্থী।

3. Sterile neutrinos: নিউট্রিনোর বিশেষ এক ধরনের রূপ যা স্বাভাবিক ইন্টারঅ্যাকশনে অংশ নেয় না।

 

তবে এখনও এই কণাগুলো কেউ প্রত্যক্ষভাবে শনাক্ত করতে পারেনি। পৃথিবীর বিভিন্ন পরীক্ষাগারে যেমন LUX-ZEPLIN (USA), XENON (ইতালি), এবং CERN-এ গবেষণা চলছে।

ডার্ক ম্যাটারের গুরুত্ব

ডার্ক ম্যাটার মহাবিশ্বের গঠন এবং বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মহাকর্ষ শক্তি ছাড়া গ্যালাক্সি গঠিত হতো না। এটি গ্যালাক্সির মধ্যে তারকাগুলিকে একত্রে ধরে রাখে, ঠিক যেন আঠা দিয়ে আটকানো হয়েছে। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মহাবিশ্বের বৃহৎ পরিসরে ডার্ক ম্যাটার একধরনের অদৃশ্য কাঠামো (cosmic web) তৈরি করেছে, যার ওপর ভিত্তি করেই গ্যালাক্সিগুলো গঠিত হয়েছে।

ডার্ক এনার্জি: প্রসারণের গোপন শক্তি

ডার্ক এনার্জি হলো মহাবিশ্বের আরেকটি রহস্যময় উপাদান। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে এটি মহাবিশ্বের প্রায় ৬৮% জুড়ে আছে। ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব প্রথম অনুধাবন করা হয় ১৯৯৮ সালে, যখন দুটি স্বাধীন গবেষণা দল সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করে আবিষ্কার করেন যে মহাবিশ্ব কেবল প্রসারিতই হচ্ছে না, বরং সেই প্রসারণ দিন দিন দ্রুততর হচ্ছে।

এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা ধারণা দেন ডার্ক এনার্জির — এমন এক শক্তি যা মহাবিশ্বকে প্রসারিত করছে, এমনকি মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে।

ডার্ক এনার্জির উৎস কী?

ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জ্ঞান এখনো খুবই সীমিত। এর সম্ভাব্য উৎস সম্পর্কে কিছু মতামত রয়েছে:

 

1. কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট (Cosmological Constant): আইনস্টাইন প্রথম এই ধারণা দেন, যে মহাকাশ নিজেই একধরনের শক্তি ধারণ করে যা মহাবিশ্বের প্রসারণ ঘটায়। একে বলা হয় “ভ্যাকুয়াম এনার্জি”।

2. কুইন্টেসেন্স (Quintessence): এটি একটি গতিশীল ক্ষেত্র, সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় এবং মহাবিশ্বের প্রসারণে ভূমিকা রাখে।

3. মডিফায়েড গ্র্যাভিটি থিওরি: কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন হয়তো আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব বড় পরিসরে ভুল হতে পারে এবং সেটি সংশোধন করলেই ডার্ক এনার্জির প্রয়োজন হবে না।

ডার্ক এনার্জির প্রভাব

 

ডার্ক এনার্জির কারণে মহাবিশ্বের প্রসারণ ক্রমশ বাড়ছে। ভবিষ্যতে এই প্রসারণ এত বেশি হতে পারে যে গ্যালাক্সিগুলো একে অপর থেকে এত দূরে সরে যাবে যে রাতের আকাশে তারা পর্যন্ত দেখা যাবে না। এমনকি, যদি ডার্ক এনার্জির পরিমাণ বাড়তেই থাকে, তাহলে একদিন সবকিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে — এই ধারণাকে বলা হয় “Big Rip”।

 

মহাবিশ্বের গঠন: একটি তুলনামূলক চিত্র

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মহাবিশ্বের গঠন নিম্নরূপ:

ডার্ক এনার্জি: ৬৮%

ডার্ক ম্যাটার: ২৭%

দৃশ্যমান পদার্থ: ৫%

এই চিত্রই বলে দেয়, আমরা আসলে কতো অল্প জানি। আমাদের সমস্ত প্রযুক্তি, জ্ঞান ও সভ্যতা মহাবিশ্বের মাত্র ৫% এর ওপর ভিত্তি করে গঠিত।

ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির গবেষণা ও ভবিষ্যৎ

বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি শনাক্ত করতে নানা ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির Euclid মিশন এবং NASA-র Nancy Grace Roman স্পেস টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের এই রহস্যময় উপাদানগুলোর প্রকৃতি অনুসন্ধানে নিয়োজিত।

 

বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে হয়তো আমরা এই রহস্যের কিছুটা সমাধান করতে পারব। তবে এটা নিশ্চিত, এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে

 

ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এই ভিডিওতে

উপসংহার:

ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি আমাদের মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এগুলোকে না জেনে আমরা মহাবিশ্বকে পূর্ণভাবে বুঝতে পারি না। যদিও আমরা এখনো জানি না এরা কী, তবে বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে চেষ্টা করে চলেছেন এই রহস্যের সমাধানে। একদিন আমরা হয়তো জানতে পারব, মহাবিশ্বের এই অদৃশ্য শক্তিগুলো কিভাবে

কাজ করে, কী দিয়ে গঠিত — এবং সেই দিনটি হতে পারে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা।